উল বাগানের পরিকল্পনা ও নকশা

এসএসসি(ভোকেশনাল) - ফ্রুট এন্ড ভেজিটেবল কাল্টিভেশন-২ - প্রথম পত্র (নবম শ্রেণি) | | NCTB BOOK
1

ফল বাগানের পরিকল্পনা একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় । ফল বাগান স্থাপনের পূর্বেই সার্বিকদিক বিবেচনায় রেখে পরিকল্পনা ও নকশা তৈরি করতে হবে। বেশিরভাগ ফল গাছই বৃক্ষজাতীয় গাছ। পারিপার্শিক পরিবেশ, আবহাওয়া, মাটির গুণাগুণ, জনগণের চাহিদা, বাজার ব্যবস্থা উন্নতজাত ও প্রযুক্তি প্রাপ্তি ইত্যাদির ওপর নির্ভর করে বাগানের পরিকল্পনা করতে হয় । বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে পরিকল্পনা না করা হলে অযথা অর্থব্যয় হবে ও ফল চাষে ব্রতী হবে । ফল বাগানের জন্য সব সময়ই উঁচু, খোলামেলা, পানি নিকাশের সুবিধাযুক্ত এবং জলাবদ্ধতা হয় না এমন খান । নির্বাচন করতে হয়। বিভিন্ন জাতের ফল গাছ বিভিন্ন ধরনের আবহাওয়া ও মাটিতে ভালভাবে জন্মাতে পারে । মাটির গুণাগুণ অনেক ক্ষেত্রে পরিচর্যার মাধ্যমে পরিবর্তন করা যায় । কিন্তু আবহাওয়া পরিবর্তন করা যায় না । ফলের গাছ স্বল্প মেয়াদী, মধ্যম মেয়াদী ও দীর্ঘ মেয়াদি হয়ে থাকে । দীর্ঘমেয়াদি ফল গাছ ৩০/৪০ থেকে ৫০/৬০ বছর পর্যন্ত ভালভাবে ফল দিয়ে থাকে । মধ্য মেয়াদি ফলগাছ ১৫ থেকে ২০ বছর ভালভাবে ফল দিয়ে থাকে । স্বল্পমেয়াদি ফল গাছ ১-৩ বছর পর্যন্ত ফল দিয়ে থাকে । দীর্ঘ ও মধ্য মেয়াদি ফল গাছ রা পণের সময় স্থান নির্বাচনে, নকশা তৈরিতে, রোপণের দূরত্ব নির্ধারণে, জাত বাছাই ইত্যাদি বিবেচনায় যদি ভুল হয়, আর তা যদি বাগান স্থাপনের কয়েক বছর পর জানা যায় তাহলে তা সারিয়ে নেয়ার সুযোগ থাকে না । বাগান লাভজনক করতে হলে দীর্ঘ ও মধ্য মেয়াদী বাগানে আন্তফসলের চাষ করা যেতে পারে । যেমন— আম, জাম, কাঁঠাল, লিচু, নারিকেল প্রভৃতি ফল গাছ ৮-১০ বছরের আগে ভালভাবে ফল দেয় না । সে জন্য এ সময় সেখানে পেঁপে, কলা, আনারস, জামরুল, আতা, শরিফা, কুল লাগিয়ে খরচ পুষিয়ে নেয়া যেতে পারে ।

ফল বাগান পরিকল্পনার সাধারণ নীতিমালা

(১) ফল বাগান স্থাপন এবং কোন নির্দিষ্ট ফল ভালভাবে চাষের জন্য তার উপযোগী আবহাওয়া, জমির উচ্চতা, মাটির প্রকারভেদ, ফল সংগ্রহ ও সংরক্ষণ, বাজারজাতকরণ, পরিবহণ ও বিপণনের সুযোগ সুবিধা ইত্যাদি বিষয় বিবেচনা করতে হবে ।

(২) পতিত জমিতে বাগান করতে হলে সেখানে পুরাতন গাছ বা গাছের গোড়া থাকলে তা পরিষকার করে গভীরভাবে চাষ করতে হবে । পাহাড়ী এলাকা হলে কন্টুর এবং সিড়িবাধ তৈরি করে কিছু দূর পর্যন্ত সমতল করে নিতে হবে ।

(৩) বাগান তৈরিতে রাস্তা, সেচ ও নিষ্কাশন নালা, বাগানের গুদামঘর ইত্যাদি কাজের জন্য কোনক্রমেই মোট জমির শতকরা দশভাগের বেশি ব্যবহার করা সমিচিন হবে না ।

(৪) বাগানে সেচ সুবিধার জন্য কাছাকাছি পানির ব্যবস্থা থাকা দরকার । 

(৫) চিরসবুজ গাছগুলো বাগানের সামনে এবং ভেতরে লাগাতে হবে । পাতা ঝরে যায় এমন গাছ যেমন— বেল, আমড়া, বরই ইত্যাদি পিছনে এবং বাইরে লাগাতে হবে । 

(৬) সেচ দেয়ার প্রয়োজন হয় এমন গাছ পানির উৎসের কাছাকাছি এবং বৃষ্টিনির্ভর গাছ পানির উৎস হতে দূরে লাগাতে হবে । 

(৭) ছোট আকারের গাছ বাগানের সামনে এবং লম্বা ধরনের গাছ পেছনের দিকে লাগাতে হবে, তাতে বাগান তত্ত্বাবধানে সুবিধা হবে । 

(৮) বর্ষার শুরুতে সঠিক দূরত্বে গর্ত করে পরিমাণ মত সার দিয়ে চারাগাছ লাগাতে হবে । 

(৯) গাছের সঠিক বৃদ্ধির জন্য পরিমাণ মত জৈব ও অজৈব সার প্রয়োগ করতে হবে ।

(১০) ফলের বাগানে আন্তফসলের চাষাবাদ করলে গাছের দূরত্বের সর্বোচ্চ দূরত্বে এবং তা না করলে সর্বনিম্ন দুরত্বে গাছ লাগাতে হবে । 

(১১) বাগানের চারিদিকে প্রয়োজনে বেড়া দিতে হবে । প্রবল বাতাস থেকে গাছ রক্ষার জন্য উত্তর পশ্চিম দিকে বায়ুরোধকারী বৃক্ষ ঘন সারি করে লাগাতে হবে । বেড়া গাছ গ্রীষ্মের গরম বাতাস এবং শীতের শুষ্ক ও ঠান্ডা বাতাস থেকে বাগানের ফল গাছকে রক্ষা করবে । বেড়ার চারদিকে কাটাওয়ালা পাতি, কাগজি ও গন্ধরাজ লেবুর গাছ ও করমচা গাছ লাগানো যেতে পারে । এতে বেড়ার কাজ হবে এবং ফলও পাওয়া যাবে । তবে বেড়ার জন্য লাগালে এসব গাছ ছাটা ঠিক হবে না । 

(১২) উর্বর জমিতে লাভজনকভাবে ফল চাষের জন্য যে সমস্ত ফল গাছ মাটামুটি একই সময়ে ফল দেয় সে সমস্ত ফল গাছগুলোকে পাশাপাশি লাগাতে হবে । 

(১৩) বাগানের নক্সা তৈরির আগে গাছের আকার, জমির পরিমাণ ও জমির আকৃতি, গাছ রোপণ প্রণালী ঠিক করে নিতে হবে । 

(১৪) ফলের বৈশিষ্ট্য অনুযায়ী বিভিন্ন সময়ে বাঁশের ঝুড়ি, চটের ব্যাগ, কাঠের বা পিচবার্ডের বাক্সে প্যাকিং করে বাজারে পাঠাতে হবে । তাই বাগান এলাকার আশেপাশে এ সমস্ত উপকরণসমূহের সহজলভ্যতা থাকতে হবে। 

(১৫) ফল চাষ করে সহজে এবং কম খরচে যাতে বাজারে বা চিহ্নিত স্থানে নিয়ে যাওয়া যায় সে বিষয়টি খেয়াল করতে হবে। 

(১৬) বাগানের পরিচর্যার জন্য যন্ত্রপাতি যথা- কোদাল, নিড়ানি, ঝাঝরি, ফর্ক, রেফ, দা, প্রুনিংস, কাঁচি, বাডিং ছুরি, প্রেয়ার, এক চাকার ঠেলাগাড়ি প্রভৃতির ব্যবস্থা রাখতে হবে ।

ফল গাছ লাগানোর নকশার প্রকারভেদ

উন্নত পদ্ধতিতে এবং লাভজনকভাবে ফল বাগান করতে হলে বাগানে গাছ লাগানোর জন্য নকশা তৈরি করা একান্ত প্রয়োজন । বাগান তৈরির আগে প্রথমে কাগজে নকশা তৈরি করে ভুলত্রুটি দেখে নিতে হবে । বাগানের নকশা তৈরি করে পরিকল্পনা অনুযায়ী বাগানের অফিসঘর, গুদামঘর, গার্ডশেড, পানির পাম্পের স্থান, ভেতরের রাস্তা, সেচ ও নিকাশ নালা, নির্দিষ্ট ফল গাছের জন্য নির্বাচিত স্থান, বেড়ার গাছ যথাস্থানে আছে বা করা যাবে কিনা তা জেনে নিতে হয় । জমির সুষ্ঠু ব্যবহার এবং জমির অপচয় রোধে প্রত্যেকটি কাজের জন্য জমি চিহ্নিত করে ফল গাছের রোপণ পদ্ধতি অনুযায়ী রোপণ দূরত্ব ঠিক করে, সেচ পদ্ধতি পরিচর্যা ইত্যাদি বিষয় বাগানের নকশায় উল্লেখ করতে হবে । বাগানের নকশা ও পরিকল্পনার মাধ্যমে মাটির উর্বরতা ও অবস্থান দেখে সর্বাধিক সংখ্যক গাছ লাগানো যায় । তাতে প্রতিটি গাছ সুন্দরভাবে আলো-বাতাস পেয়ে বড় হতে পারে । পরিকল্পনা মোতাবেক গাছ লাগালে নির্ধারিত দূরত্ব বজায় থাকে এবং একটি অন্যটির বৃদ্ধিতে বাধা সৃষ্টি করে না । বিভিন্ন পদ্ধতিতে ফল বাগানের নকশা বা পরিকল্পনা করা হয় । এ পদ্ধতিগুলো যথা—

১ । আয়তকার  

২ । বর্গাকার 

৩ । পঞ্চম সংস্থান বা তারকাকৃতি বা কুইনকাংশ 

৪ । ত্রিকোনী বা ত্রিভুজাকার 

৫ । ষড়ভুজী 

৬ । কন্টুর বা সিঁড়িবাধ

উলিখিত ছয় প্রকার গাছ রোপণ পদ্ধতির প্রধান প্রধান বিষয়গুলো নিচে আলোচনা করা হলো । তবে রোপণ পদ্ধতি নির্ধারণ করার সময় কতকগুলো বিষয় বিবেচনা করা উচিত । যথা—

(ক) নির্দিষ্ট পরিমাণ জমিতে কত বেশি সংখ্যক গাছ রোপণ করা যাবে । 

(খ) জমি চাষ, পানি সেচ ও নিকাশ, গাছের পরিচর্যা কত সহজে ও সুষ্ঠুভাবে করা যাবে । 

(গ) চারা রোপণের পদ্ধতির কারণে যেন গাছের বৃদ্ধি ব্যাহত না হয় । 

(ঘ) এমনভাবে গাছ লাগাতে হবে যাতে বাগান দেখতে সুন্দর দেখায় ।

চারা রোপণের জন্য নকশা প্রণয়নে করণীয় কাজসমূহ

ক) মূলরেখা চিহ্নিতকরণ: প্রতিটি জমিতে চারা রোপণের আগে জমির কিনারা বা আইল দিয়ে সীমানা রেখা টানতে হবে । এরপর একটি মূলরেখা টেনে নিতে হয় । সাধারণত প্রতিটি জমিতে গাছের প্রথম সারিটি মূল রেখা হিসেবে ধরে নেয়া হয় । এ সারিটি জমিতে সারি থেকে সারির যে দূরত্বে গাছ লাগানো হবে মূলরেখাটি জমির কিনারা বা আইল হতে তার অর্ধেক দূর দিয়ে নিতে হবে। এ সারিকে মুল সারি বা ভিত্তি সারি হিসেবে বিবেচনা করা হয় । এর উপর গাছ হতে গাছের দূরত্ব চিহ্নিত করে অপরাপর সারিগুলো এমনভাবে টানতে হবে যেন একটি আরেকটির সাথে পরস্পর সমান্তরালভাবে থাকে ।

খ) জমিতে লম্বরেখা গঠন: জমির এক কোণে দাঁড়িয়ে বা মূল সারির এক প্রান্তে দাড়িয়ে যথাযথ দৈর্ঘ্যবিশিষ্ট । একটি রশি ধরে ৩ : ৪ : ৫ অনুপাতে বা ১২, ১৩, ২০ মিটার হিসেবে জমির দুই দিকের আইল বরাবর রশি ধরে চিহ্নিত করতে হবে । অর্থাৎ কৌণিক স্থান হতে উভয় দিকের আইল বরাবর দুদিকে রেখা টেনে একটিতে ১২ মিটার এবং অপরটিতে ১৬ মিটার দূরত্ব চিহ্নিত করতে হবে । এই চিহ্নিত স্থান দুটি সোজাসুজি সংযোগ করা হলে সংযোজিত রেখাটি যদি ২০ মিটার হয় তাহলে সংযোগস্থলে ৯০ ডিগ্রী কোণ তৈরি হবে। এরপর উভয়দিকের রেখা সরল রেখা হিসেবে প্রসারিত করা হলে একটি অপরটির উপর লম্বরেখা হিসেবে অঙ্কিত হবে । এর একটিকে মূলরেখা ধরে সমান্তরাল রেখা টানতে হবে । তবে মূল রেখাটি জমির কিনারা বা আইলে না ধরে সারি হতে সারির অর্ধেক দূরত্বে ধরতে হয় ।

গ) মুক্ত রেখা প্রতুতকরণ: জমিতে আইল বরাবর লম্ব রেখা টেনে তারপর মূলরেখা তৈরি করা হয়। এ মূলরেখার গাছ রোপনের চিহ্নিত স্থান হতে পরবর্তী রেখার বা সমান্তরাল রেখার চিহ্নিত স্থানে লম্ব রেখার উপর হতে মূল রেখার সমান্তরাল রেখা সংযোগে করা হলে মুক্ত রেখা তৈরি হয় । এ ভাবে মূলরেখার ওপর গাছের দূরত্ব অনুসারে প্রতিটি সারিতে সারি হতে সারির অংকিত রেখায় যতগুলো সম্ভব স্থান চিহ্নিত করে সংযোগ করতে হবে । তবে মূলরেখার উপর এক দিক হতে বা উভয়দিক হতে গাছ রোপণের জন্য নির্ধারিত দূরত্বের অর্ধেক দূরত্ব হতে গাছ রোপণের নিমিত্তে উলিখিত রেখাগুলো তৈরির জন্য চিহ্নিতকরণ দন্ড বা গোজ, দূরত্ব মাপার ফিতা, রশি, গাছের স্থান চিহ্নিত করে রাখার জন্য চিকন কাঠির প্রয়োজন ।

 

ফল গাছ রোপণের পদ্ধতিগুলো নিচে বর্ণনা করা হলো

(১) আয়তাকার পদ্ধতি: এ পদ্ধতিতে পাশাপাশি দুই বা ততোধিক সমান্তরাল সারির মধ্যে মূল সারিতে গাছের স্থান চিহ্নিত করতে হবে । এরপর মূল রেখার চিহ্নিত স্থান হতে পরবর্তী সারিগুলোকে লম্বরেখায় চিহ্নিত করে মুক্ত রেখা চিহ্নিত করতে হবে। এর ফলে পাশাপাশি দুসারির মধ্যে চারটি গাছের সমন্বয়ে একটি আয়তক্ষেত্রের সৃষ্টি হবে ।

সাধারণত আয়তাকার পদ্ধতিতে সারি থেকে সারির দূরত্ব গাছ থেকে গাছের দূরত্বের চেয়ে বেশি থাকে । এ পদ্ধতিতে লাগানো ফল বাগানে আন্ত পরিচর্যা যেমন- চাষ, পানি সেচ, কোপানো, আগাছা পরিষ্কার ইত্যাদি কাজ সুবিধাজনক হয় । বাগানের জন্য রোপিত গাছ বড় হওয়ার আগে এর মাঝে শাক, আলু, তরমুজ, ফুটি, হলুদ, কচু, ডাল জাতীয় শস্য ইত্যাদি কয়েক বছর করা যায় । এর ফলে বাড়তি আয় করা সম্ভব হয় ।

হেক্টর প্রতি গাছের সংখ্যা নির্ণয়ের পদ্ধতি (আয়তাকার বা বর্গাকার পদ্ধতি):

এক হেক্টর জমিতে মোট গাছের সংখ্যা = এক হেক্টর জমি = ১০০০০ বর্গমিটার

সারি থেকে সারির দূরত্ব (ব:মি:) ×  গাছ থেকে গাছের দূরত্ব (ব:মি:) অথবা

সারির সংখ্যা প্রতি সারিতে গাছের সংখ্যা

উদাহরণ: পেঁপে বাগানে ৫ মিটার দূরত্বে সারি করে ২ মিটার দূরত্বে চারা রোপণ করলে এক হেক্টর জমিতে কতটি চারা রোপণ করা যাবে-

অর্থাৎ এক হেক্টর জমিতে ১০০০টি চারা রোপণ করা যাবে ।

(২) বর্গাকার পদ্ধতি: এ পদ্ধতিতে পাশাপাশি দু'সারির গাছগুলোকে এমনভাবে রোপণ করা হয়, যাতে সারি হতে সারি এবং গাছ হতে গাছের দূরত্ব পরস্পর সমান থাকে । অর্থাৎ পাশাপাশি দুসারির চারটি গাছ মিলে একটি বর্গক্ষেত্র তৈরি করে । বর্গক্ষেত্রের চারকোনার স্থানগুলোতে গাছ রোপণ করা হয় । আম, কাঁঠাল, লিচু, সফেদা, জাম, জামরুল, পেয়ারা, পেঁপে প্রভৃতি ফল গাছের চারা এ পদ্ধতিতে রোপণ করা হয় । এ পদ্ধতিটি তুলনামূলকভাবে সহজ এবং মাঠে সহজে নকশা প্রণয়ন করা যায়।

জমিতে মুলরেখা তৈরি করার পর নির্দিষ্ট দূরত্ব অনুসারে সম্পূর্ণ মূল রেখায় কাঠি বা গোজ পুঁতে চারা রোপণের স্থান চিহ্নিত করতে হবে । মূলরেখার সঙ্গে লম্বরেখা টেনে সারি হতে সারির দূরত্ব চিহ্নিত স্থান হতে মূল রেখার সমান্তরাল রেখা টানতে হবে । এরপর প্রথম সারি বা মূলরেখার চিহ্নিত স্থান হতে লম্বরেখা টেনে নিলে পরবর্তী সারিগুলোতে যেখানে রেখাগুলো অতিক্রম করবে সে স্থানগুলোতে কাঠি বা গোঁজ পুঁতে দিতে হবে । প্রত্যেকটি স্থানে গাছ রোপণ করা হলে প্রতি চারটি গাছ মিলে এক একটি বর্গক্ষেত্র তৈরি করবে । এ পদ্ধতিটি বেশি প্রচলিত এবং দেখতে সুন্দর দেখায় । এখানে উল্লেখ্য যে মূলরেখাটি জমির আইল হতে সারি হতে সারির দূরত্ব বাদ দিয়ে প্রথম গাছের স্থান চিহ্নিত করা হয় । বর্গাকার পদ্ধতিতে মোট গাছের সংখ্যা নির্ণয়ের জন্য আয়াতাকার পদ্ধতির অনুরূপ নিয়ম অনুসরণ করতে হবে ।

উদাহরণ একটি আম বাগান করার জন্য ১০ মিটার দূরে দূরে সারি ও ১০ মিটার দূরে দূরে চারা/কলম রোপণ করা হলে এক হেক্টর জমিতে মোট কতটি চারার প্রয়োজন হবে ।

অর্থাৎ এক হেক্টরে ১০০টি চারা বা কলম রোপণ করা যাবে ।

(১) কুইনকাংশ বা পঞ্চম সংস্থান বা তারকাকৃতি পদ্ধতি: এ পদ্ধতিটি বর্গাকার পদ্ধতির একটি বিশেষ রূপ । বর্গাকার পদ্ধতির প্রতি চার কোণের চিহ্নিত স্থান হতে মূল রেখার উপর বা পরবর্তী সারিগুলোতে দুই গাছের চিহ্নিত মধ্যবর্তী স্থানে চিহ্নিত করতে হবে । অনুরূপভাবে মুক্ত রেখাগুলোর উপর প্রতি দুই সারির মধ্যবর্তী স্থানে চিহ্নিত করতে হবে । এখন মূল রেখা বা পরবর্তী সারিগুলোর মধ্যবর্তী স্থান এবং মুক্ত রেখার মধ্যবর্তী স্থানে চিহ্নিত করতে হবে । এরপর মুল রেখা বা পরবর্তী সারিগুলোর মধ্যবর্তী স্থান এবং মুক্ত রেখার মধ্যবর্তী স্থান হতে সামনা সামনি দিকে রেখা টানলে বর্গক্ষেত্রের কেন্দ্রবিন্দুতে মিলিত হবে। এই কেন্দ্রবিন্দু হবে পঞ্চম সংস্থান । কেন্দ্রবিন্দুর সংস্থানকৃত গাছটিকে ফিলার বা পূরক বলে । বর্গাকার পদ্ধতিতে চারকোনে মধ্যম মেয়াদী বা দীর্ঘমেয়াদী গাছ লাগানো হয় এবং পুরক গাছটি স্বল্পমেয়াদী হিসেবে লাগানো হয় । যেমন— দীর্ঘমেয়াদী গাছ হলো আম, কাঁঠাল, লিচু, জাম, কামরাঙ্গা, তেঁতুল এবং স্বল্পমেয়াদী গাছ হলো লেবু, ডালিম, পেয়ারা, আতা, শরীফা, জাম্বুরা, কলা, জামরুল, করমচা ইত্যাদি । পুরক গাছগুলো যখন মধ্যমমেয়াদি বা দীর্ঘমেয়াদি গাছের সাথে আলো, বাতাস, খাদ্য উপাদান, পানি ইত্যাদির জন্য প্রতিযোগিতায় যাবে তখন পূরক গাছগুলো কেটে ফেলতে হবে । স্থায়ী গাছের দূরত্ব কমপক্ষে ৭ মিটার না হলে এ পদ্ধতি তেমন ফলপ্রসূ হিসেবে অনুশীলন করা যাবে না।

কুইনকাংশ বা পঞ্চম সংস্থান পদ্ধতিতে জমিতে গাছের সংখ্যা নির্ণয়

জমিতে মোট গাছের সংখ্যা = (সারির সংখ্যা × সারিতে গাছের সংখ্যা) + পুরক গাছ

পুরক গাছ = (প্রধান সারিতে গাছের সংখ্যা - ১) × (সারির সংখ্যা - ১)

উদাহরণ: কোন জমিতে ১২টি সারি তৈরি করে প্রতিটি সারিতে ১০টি করে চারা রোপণ করা হলে ঐ জমিতে পঞ্চম সংস্থান পদ্ধতিতে কতটি চারা রোপণ করা যাবে ।

৪) ত্রিকোণী বা ত্রিভুজাকার পদ্ধতি: মূলরেখা তৈরি করে মূল রেখার উপর বর্গাকার পদ্ধতির ন্যায় গাছের দূরত্ব চিহ্নিত করতে হবে । এরপর দ্বিতীয় সারিতে জমির কিনারা হতে গাছের দূরত্বের পূর্ণ দূরত্বে চিহ্ন করতে হবে । এই ভাবে পরবর্তী চিহ্নগুলো গাছের পূর্ণ দুরত্বে করতে হবে। এতে মূলরেখায় গাছের নির্ধারিত দুটি গাছের চিহ্নের মধ্যবর্তী স্থান বরাবর দ্বিতীয় সারিতে গাছের চিহ্ন পড়বে। এ পদ্ধতিতে প্রতি একান্তর বা জোড়া সারিতে প্রথম সারির দুই গাছের মধ্যবর্তী স্থানে গাছ লাগানো হয় এবং এরপর প্রতি বেজোড় সারিতে বর্গাকার পদ্ধতির ন্যায় গাছ লাগানো হয়। এতে প্রথম বা মূলরেখার দুটি এবং একাত্তর সারির একটি গাছের চিহ্ন যোগ করা হলে মাত্র একটি ত্রিভুজের সৃষ্টি করে । অনুরূপভাবে একাত্তর বা জোড় সারির একটি গাছ তৃতীয় বা বেজোড় সারির দুটি গাছের চিহ্নের সাথে যাগে করা হলে ত্রিভুজের সৃষ্টি করে । ত্রিভুজগুলো সমবাহু ত্রিভুজ হয় । ১ম, ৩য়, ৫ম বা বেজোড় সংখ্যক লাইনে বর্গাকার প্রণালীতে গাছ লাগানো হয় এবং ২য়, ৪র্থ, ৬ষ্ঠ বা জোড় সংখ্যক লাইনে বেজোড় লাইনের দুটি গাছের মধ্যবর্তী স্থানে গাছ লাগানো হয় । এ পদ্ধতিতে সারি হতে সারির দূরত্ব গাছ হতে গাছের দূরত্ব অপেক্ষা বেশি রাখা হয় । প্রতি এক সারি পর পর বা একান্তর সারিতে একটি করে গাছ কম হয় । এতে করে মোট জমিতে বর্গাকার পদ্ধতি অপেক্ষা গাছের সংখ্যা কমে যায় ।

ত্রিভূজাকার পদ্ধতিতে জমিতে মোট গাছের সংখ্যা নির্ণয় 

জমিতে মোট গাছের সংখ্যা = (প্রথম সারিতে গাছের সংখ্যা  × মোট সারির সংখ্যা) - একান্তর ক্রমিক (জোড় সারির সংখ্যা

উদাহরণ: এটি জমির দৈর্ঘ্য ৫০ মিটার এবং প্রস্থ ৩০ মিটার । এ জমিতে ১০ মিটার দূরে দূরে সারি করে একই দূরত্বে গাছ রোপণ করা হলে মোট কতটি গাছ রোপণ করা যাবে।

৫। ষড়ভুজী পদ্ধতি: ষড়ভুজী পদ্ধতি একটি সমবাহু ত্রিভুজাকার পদ্ধতি । এখানে পাশাপাশি দুই সারির তিনটি গাছ মিলে একটি সমবাহু ত্রিভুজ তৈরি করে। পাশাপাশি তিন সারির ছয়টি গাছ মিলে একটি ষড়ভুজ তৈরি করে । এর কেন্দ্রস্থলে একটি গাছ থাকে । গাছের দূরত্ব নির্দিষ্ট রাখতে হলে সারি হতে সারির দূরত্ব কমিয়ে দিতে হয় । প্রকৃতপক্ষে ষড়ভুজ তৈরি কিছুটা জটিল হলেও গাছ লাগানো হলে দেখতে সুন্দর দেখায় । যে কোন দিক হতে তাকালে লাগানো গাছগুলো একটি সরল রেখায় দেখা যায়। একগাছ থেকে অপর গাছের দূরত্ব সমান থাকে । ফলে আলো, বাতাস, খাদ্য উপাদান, পানি ইত্যাদি সকল গাছ সমানভাবে পায় । আম, কলা, আপেল, পীচ, লেবু, পেয়ারা, নারিকেল কাজুবাদাম প্রভৃতি ফল গাছের চারা এই পদ্ধতিতে লাগানো হয় । ষড়ভুজ পদ্ধতিতে গাছ লাগালে দূরত্ব ৷ ঠিক রেখেও ১৫% গাছ বেশি লাগানো যায় । ফলে একই জমি থেকে ১৫% অধিক ফল উৎপাদন করা সম্ভব ।

ষড়ভুজী পদ্ধতি জমিতে চারা সংখ্যা নির্ণয়

জমিতে মোট চারার সংখ্যা = (মোট সারির সংখ্যা  × প্রধান বা প্রথম সারিতে গাছের সংখ্যা) - জোড় বা একান্তর ক্রমিক সারির সংখ্যা ।

উদাহরণ: এক খণ্ড জমির দৈর্ঘ্য ৫০ মিটার এবং প্রস্থ ৪০ মিটার । ৫ মিটার দূরে দূরে সারি এবং ৮ মিটার দূরে দূরে চারা রোপণ করা হলে ঐ জমিতে মোট কতটি চারা রোপণ করা যাবে ।

(৬) কন্টুর বা ঢাল এবং সিড়িবাধ পদ্ধতিঃ পার্বত্য অঞ্চলে ঢাল এবং সিড়িবাঁধ নির্মাণ করে ঢালের আড়াআড়িভাবে ফলের চারা রোপণ করা হয় । জমিতে চাল ৩ শতাংশের বেশি এবং ১০ শতাংশের কম থাকলে সেখানে কন্টুর বা ঢাল পদ্ধতি ব্যবহার করা হয়। এ পদ্ধতিতে জমির ঢাল অনুযায়ী সমান স্থানগুলোকে একই রেখা দ্বারা সংযোগ করে দেয়া হয় । যেখানে ভূমিক্ষয়ের সম্ভাবনা থাকে এবং সেচ দেয়া অসুবিধাজনক সেখানে এ পদ্ধতিতে গাছ লাগানো হয় । এখানে স্বাভাবিক ভাবে লাগানো গাছের পারস্পরিক দূরত্ব কখনও সমান রাখা সম্ভব নয় । পাহাড়ের ঢাল ১০ শতাংশের বেশি হলে পাহাড় কেটে সমতল সিঁড়িবাধ তৈরি করা হয় এবং ঢালের সাথে আড়াআড়িভাবে সারি করে গাছ লাগানো হয় । এখানে প্রথম সারির দুটি গাছের মধ্যবর্তী স্থানে পরবর্তী সারিতে গাছ লাগিয়ে জমির ক্ষয়রোধ করা হয় । এর ফলে সিড়ি বাঁধ পদ্ধতিতে পানিসেচ ও ভূমি ব্যবস্থাপনা ঠিকমত করা যায় ও ভূমিক্ষয় রোধ করা যায় । এ কাজের জন্য ঢালের নিচের দিকে কিছুটা উঁচু করে আইল বা বাঁধ দিতে হয় ।

সকল প্রকার পদ্ধতিতেই গাছ লাগানোর মানে কাঠি বা গেজ দিয়ে চিহ্ন করতে হয়। গোজ তুলে দিয়ে ফল গাছের আকৃতি অনুসারে বিভিন্ন আকারের গর্ত খুড়ে পরিমাণ মত সার দিয়ে গর্ত পূরণ করতে হয় । সার মিশ্রিত মাটি দিয়ে গর্ত পূরণ করে অন্তত ৮-১২ দিন পরে ঐ গর্তে ফলের চারা রোপণ করতে হয় । ফল গাছ রোপণের জন্য নকশা সঠিক নির্বাচন এবং সঠিক দূরত্ব বজায় রাখা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ । কেননা অপর্যাপ্ত পরিসরে গাছ ভালোভাবে বাড়তে পারে না। ফলে ফল কম ধরে ও নিম্নানের হয় । গাছ কাছাকাছি হলে রোগ ও পোকা-মাকড়ের আক্রমণ সহজে বিস্তার লাভ করতে পারে । অন্যদিকে অধিক পরিসরে গাছ লাগালে মূল্যবান জমির অপচয় হয়, জমিতে বেশি আপাছা হওয়ার সুযোগ পায়, জমি তাড়াতাড়ি শুকিয়ে যায় এ ভূমির ক্ষয় হয় ।

বর্গাকার পদ্ধতি

সুবিধা

১) এ পদ্ধভিটি তুলনামূলকভাবে সহজ। কেননা মাঠে নকশা প্রণয়নে কোন ঝামেলা হয় না । 

(২) বর্ণক্ষেত্রের প্রতি কোণায় একটি করে গাছ লাগানো হয় । তাই প্রতিটি গাছ সমান দূরত্ব পায় এবং সহজে বেড়ে উঠতে পারে । 

(৩) স্বল্পমেয়াদি ও দ্রুতবর্ধনশীল ফল গাছের জন্য এ পদ্ধতি সঠিক উপযোগী। 

অসুবিধা

(১) সাধারণত দীর্ঘমেয়াদি এবং বর্ধনশীল ফসলসমূহ এ পদ্ধতিতে লাগানো বিশেষ উপযোগী নয় । 

(২) ফল গাছ লাগানোর কিছু কিছু নকশার বেশি গাছ লাগানো যায় কিন্তু এ পদ্ধতিতে কম সংখ্যক গাছ লাগানো যায়। 

(৩) গাছ গোলাকার ভাবে চতুর্দিকে বাড়ে ফলে বর্গক্ষেত্রের চার কোণায় লাগানো গাছ হতে বর্গক্ষেত্রের কেন্দ্র কিন্তু বা মাঝখানের জায়গা অব্যবহৃত থাকে। আয়তাকার পদ্ধতি সুবিধা ও অসুবিধা বর্গাকার পদ্ধতির অনুরূপ

পঞ্চম সংস্থান পদ্ধতি

সুবিধা

(১) এ পদ্ধতিতে বর্গাকার বা আয়তকার পদ্ধতি অপেক্ষা কোন নির্দিষ্ট জমিতে বেশি সংখ্যক গাছ লাগানো যায়। 

(২) জমির সর্বোচ্চ ব্যবহার হয় । 

(৩) এ পদ্ধতিতে দীর্ঘমেয়াদি গাছের সাথে স্বল্পমেয়াদি গাছের সমন্বয় করা যায় । 

(৪) কিলার গাছ কেটে জ্বালানি হিসেবে ব্যবহার করা যায় ।

অসুবিধা

(১) দীর্ঘমেয়াদি গাছের সাথে স্বল্পমেয়ালি গাছের সমন্বয় করে না লাগানো হলে বাগান লাভজনক হয় না ।

(২) পঞ্চম স্থানের ও চার কোণার গাছের ফল বিভিন্ন সময়ে সংগ্রহ করতে হয় । 

(৩) এক জাতীয় রোগ ও পোকামাকড় অন্য জাতীয় গাছে পরজীবি হতে পারে ।

ত্রিকোণী বা ত্রিভুজ পদ্ধতি সুবিধা

(১) তিনদিক থেকে গাছের অতি পরিচর্যা সহজে করা যায় । 

(২) বাগান দেখতে সুন্দর দেখায় ।

অসুবিধা

(১) এ পদ্ধতিতে অন্যান্য পদ্ধতি অপেক্ষা গাছের সংখ্যা কম হয় ।

(২) নকশা করা কিছুটা ঝামেলাপূর্ণ । 

(৩) জমির অপচয় হয় ।

ষড়ভুজী পদ্ধতি

সুবিধা

(১) এ পদ্ধতিতে এক গাছ হতে অন্য গাছের দূরত্ব সমান থাকে । 

(২) তিন দিক থেকে বাগানের গাছে আন্ত পরিচর্যা করা যায় । 

(৩) বর্গাকার পদ্ধতি অপেক্ষা ১৫ % গাছ বেশি লাগানো যায় 

(৪) এ পদ্ধতিতে লাগানো বাগান দেখতে সুন্দর দেখায়

অসুবিধা 

(১) এ পদ্ধতিতে অন্যান্য পদ্ধতি (বর্গাকার বাদে) অপেক্ষা গাছের সংখ্যা কম হয় । 

(২) নকশা তৈরি কিছুটা ঝামেলাপূর্ণ । 

(৩) জমির অপচয় হয় ।

চান্স বা সিঁড়ি বাঁধ পদ্ধতি সুবিধা

(১) এ পদ্ধতিতে সুষ্ঠু নকশা প্রণয়ন করে গাছ লাগিয়ে ভূমির ক্ষয় কমানো যায় । 

(২) এ পদ্ধতিতে বর্গাকার পদ্ধতি অপেক্ষা দ্বিগুণ গাছ লাগানো যায় । 

(৩) গাছ লাগানোর জন্য রেখা তৈরির ফলে পাহাড়ের ঢাল দিয়ে বিভিন্ন দিকে চলাফেরা করা যায় । 

(৪) উঁচু দিক হতে পাইপ দ্বারা নিচের দিকে সহজে সেচের পানি প্রবাহিত করা যায় ।

অসুবিধা

(১) এ পদ্ধতিতে অন্যান্য পদ্ধতি অপেক্ষা গাছের সংখ্যা কম হয় । 

(২) নকশা তৈরি কিছুটা ঝামেলাপূর্ণ

মিশ্র ফল বাগান

বাংলাদেশে লোক সংখ্যার তুলনায় জমির মতো বেশি অভাব যে, এখানে ফলের বাগান করতে গিয়ে জমির সর্বাধিক ব্যবহার নিশ্চিত করা আবশ্যক । বর্তমানে বাংলাদেশে ৮২-৯০ লাখ হেক্টর জমি থেকে খাবার যোগান দিতে হচ্ছে প্রায় ১৫ কোটি জনগাষ্ঠেীর । গত ত্রিশ বছরে জনসংখ্যা বেড়ে দ্বিগুণ হয়েছে কিন্তু চাষযোগ্য জমির পরিমাণ বাড়েনি । বর্তমানে প্রতি বর্গকিলোমিটারে বাস করছে গড়ে ৯২৬ জন মানুষ, ফলে মাথাপিছু জমির পরিমাণ একদিকে যেমন কমে যাচ্ছে সেই সাথে কমছে চাষযোগ্য জমির পরিমাণও। অন্যদিকে মোট খাদ্যশস্যের চাহিদার বিপরীতে উৎপাদন প্রয়োজনের তুলনায় অনেক কম । সে জন্য অতিরিক্ত খাদ্যঘাটতি মেটাতে নির্ভর করতে হচ্ছে বিদেশি খাদ্য আমদানি এবং দাতাগাষ্ঠেীর সাহায্যের ওপর। অন্যদিকে ফল আমাদের দরিদ্র জনগাষ্ঠেীর নাগালের বাইরে । তাই বেশী পরিমাণ ফল উৎপাদন করে পুষ্টিহীনতা দূর করা সম্ভব । একজন মানুষের শারীরিক ও মানসিকভাবে সুস্থতার জন্য প্রতিদিন ১২০ গ্রাম করে ফল খাওয়ার প্রয়োজন । কিন্তু আমরা খাই মাত্র ৩৫-৩৮ গ্রাম, যা প্রয়োজনের তুলনায় অনেক কম ।

আবার প্রাকৃতিক ভারসাম্য বজায় রাখার জন্য একটি দেশের শতকরা ২৫% ঘন বনাঞ্চল তথা উদ্ভিজ্জ আচ্ছাদন থাকা প্রয়াজন । অথচ আমাদের প্রকৃত উদ্ভিজ্জ আচ্ছাদন মাত্র ৮.৫% যা প্রয়োজনের তুলনায় অনেক কম । সুতরাং জাতীয় চাহিদার সাথে তাল মিলিয়ে আমাদের বনভূমি বা কৃষি জমি বাড়ার যেখানে কোনো সম্ভাবনা নেই, সেখানে ফলদ ও বনজ গাছের সাথে কৃষি উদ্যানতাত্ত্বিক ফসলের মিশ্র চাষের দিকে মনোযোগ দেয়া প্রয়োজন । প্রচলিত চাষ বিন্যাস রূপান্তরের মাধ্যমে বহুস্তর বিশিষ্ট ফল বাগান করে একক জমিতে ফলন বাড়ানোর বিকল্প নেই ।

মিশ্র বাগান কী ?

মুলত মিশ্র বাগান হচ্ছে একই জমিতে বিভিন্ন চাষযোগ্য বৃক্ষ, বিরুৎ ও গুল্মজাতীয় উদ্ভিদ প্রজাতির ৩-৪ তর বিশিষ্ট বৃক্ষ রাজী সহযোগে গঠিত উদ্ভিদগুলোর একটি নিবিড় সহাবস্থান ।

মিশ্র ফল বাগানের সুবিধা

এ ধরনের বাগান পদ্ধতিতে ভূমির সর্বোচ্চ ব্যবহার নিশ্চিত হয় । বাংলাদেশের মতো ভূমি স্বল্পতার দেশে এ পদ্ধতির বাগান কৃষিতে এক যুগান্তকারী উৎপাদন ব্যবস্থা হিসেবে স্বীকৃতি পেতে পারে । ভূমি ছাড়াও অন্যান্য প্রাকৃতিক সম্পদ যেমন-আলো, মাটির পুষ্টি উপাদান, পানি ইত্যাদির সর্বাধিক ব্যবহার এ পদ্ধতিতে সম্ভব । এ ধরনের বাগান পদ্ধতিতে চাষকৃত বিভিন্ন উদ্ভিদ খাড়াভাবে বিভিন্ন স্তর থেকে সূর্যালোক গ্রহণ করে । যে পরিমাণ সুর্যের আলো পৃথিবীতে আসে তার ২০-৩০ ভাগ ব্যবহার করে উপরের স্তর অর্থাৎ বৃক্ষ, ২০-৪০ ভাগ ব্যবহার করে মধ্য স্তর অর্থাৎ বিরুৎ এবং সর্ব নিম্ন স্তরে থাকে ছায়া পছন্দকারী উদ্ভিদ যা বাকি ২০-৩০ ভাগ সূর্যের আলো গ্রহণ করে ।

অন্যদিকে গাছের মূলতন্ত্র মাটির বিভিন্ন গভীরতা থেকে পুষ্টি উপাদান গ্রহণ করে যেমন, ছায়া প্রদানকারী উদ্ভিদ মাটির ওপরের স্তর থেকে পুষ্টি নেয়, মধ্যম সতরের উদ্ভিদ মাটির আরো নিচে এবং ওপরের স্তরের উদ্ভিদ মাটির আরো গভীর থেকে পুষ্টি উপাদান সংগ্রহ করে । এতে করে প্রাকৃতিক সম্পদের সর্বোচ্চ ব্যবহার নিশ্চিত হওয়ার পাশাপাশি প্রাকৃতিক ভারসাম্যও রক্ষা হয় ।

মিশ্র ফল বাগান পদ্ধতি আর্থিকভাবে কৃষকের জন্য ঝুঁকিমুক্ত । কেননা, কোনো কারণে কৃষক এক স্তরের ফসলপ্রাপ্তি থেকে বঞ্চিত হলেও অপর স্তর থেকে ফলন পায় । এছাড়াও বছরব্যাপি এ ধরনের বাগান থেকে ফল সংগ্রহের মাধ্যমে অর্থ পাওয়া সম্ভব । কেননা একই জমিতে বিভিন্ন ফসল থাকায় বছরের ভিন্ন ভিন্ন সময়ে তা সংগ্রহ ও প্রয়োজনে বিক্রয় করা যায় । এ প্রক্রিয়ায় উদ্ভিজ্জ বৈচিত্র্যতা সংরক্ষণ করা সম্ভব । একই জমিতে বছরের প্রায় সব সময়ই বিভিন্ন প্রজাতির উদ্ভিজ্জের উপস্থিতি ফসল চাষে বহুমুখিতার পাশাপাশি ফসল তথা উদ্ভিদের বৈচিত্র্যতা রক্ষায় সহায়ক হয় ।

নিবিড় চাষ করা হয় বিধায় বসতবাড়ির মহিলারা বা বেকার যুবকরা উৎপাদন কাজে নিজেদের সম্পৃক্ত করতে পারে । এতে করে বেকার সমস্যা দূরীকরণের পাশাপাশি নারীর ক্ষমতায়নেও এ ধরনের বাগান উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখতে পারে ।

বাংলাদেশের জন্য বহুস্তরবিশিষ্ট মিশ্র ফল বাগানের কাঠামো

ভূমি সংলগ্ন লতাপাতা সমৃদ্ধ নিম্নস্তর,

বৃক্ষসমৃদ্ধ উচ্চতর এবং এ দুয়ের মধ্যবর্তী স্তর নিয়েই বসতবাড়ীর বহুস্তর বাগান । নিম্নস্তরটিকে দুটি ভাগে ভাগ করে ১মি. এর কম উচ্চতা বিশিষ্ট সর্বনিম্নভরে আনারস, তরমুজ এবং ১-৩ মি. উচ্চতায় কলা, পেঁপে, পেয়ারা, লেবু ইত্যাদি চাষ করা যেতে পারে । ওপরের স্তরটির দুটি ভাগে ভাগ করে ২৫ মি. বেশি উচ্চতায় সুউচ্চ কাঠ ও ফলদ বৃক্ষ যেমন- আম, কাঁঠাল, নারিকেল এবং ১০-১২ মি. উচ্চতায় মাঝারি উচ্চতার ফল যেমন- বামন আকৃতির আম, লিচ, সফেদা ইত্যাদি উদ্ভিদ লাগানো যেতে পারে ।

দীর্ঘমেয়াদি ফল বাগানে কি ধরনের মিশ্র ফসল করা যায় সেগুলো সম্পর্কে উল্লেখ করা হলো: 

১। ক) অধিক সুৰ্য্যালোক পছন্দকারী - কলা, পেঁপে, পেয়ারা, তরমুজ, ফুটি ইত্যাদি ।

খ) মাঝারী সূর্যালোক পছন্দকারী- লেবু, আনারস, ডালিম, পেয়ারা, জামরুল, জামবুরা, করমচা স্ট্রবেরি, মিষ্টিআলু শাক, কলমিশাক ইত্যাদি । 

গ) কম সুর্যালাকে পছন্দকারী লটকন, ইত্যাদি । বাগানে নতুন অবস্থায় উপরোক্ত বিষয় বিচেনা করে কয়েক বছর সূর্যালোক ও মাঝারি সূর্যালোক পছন্দকারী ফসল মিশ্র সাথী ফসল হিসেবে সফলভাবে জন্মানো যায় । পরবর্তীতে ফলগাছ লাগানোর জমিতে ছায়া পড়ে গেলে কম সূর্যালোকে জন্মাতে পারে এমন ফসল চাষ করা উচিত ।

২। ক) দীর্ঘমেয়াদি মূল জাতীয় ফসলের সাথে স্বল্পমেয়াদি সাথী ফসল কোন কোন ক্ষেত্রে জন্মানো যায়। যেমন– আম, কাঁঠাল, লিচু এবং জামের সাথে ডালিম, জামরুল পেঁপে ইত্যাদি চাষ করা যায় । 

খ) গভীর মূল জাতীয় ফসলের সাথে অগভীর মূল জাতীয় ফসল নির্বাচন করতে হবে । যেমন— 

i) আম, জাম, কাঁঠাল, লিচু ইত্যাদির সাথে কলা, আনারস পেঁপে ইত্যাদি । 

ii) কলা, পেঁপে, ডালিম, পেয়ারা, শরিফা, আতা, জামরুল, লেবু ইত্যাদির সাথে তরমুজ, ফুটি ইত্যাদি । 

iii) দীর্ঘমেয়াদী বা বহুবর্ষজীবী ফসলের সাথে ১-৩ বর্ষজীবি ফসল নির্বাচন করতে হবে । যেমন– আম, জাম, কাঁঠাল লিচু ইত্যাদির সাথে কলা, পেঁপে, আনারস, ষ্টব্রেরি, বেগুন ইত্যাদি । 

iv) সাথি ফসল যাতে এ ধান ফসলের ফুল ও ফল ধারণ, ফল বড় হতে বা ফলের গুণগত মানে ব্যাঘাত সৃষ্টি না করে । সে বিষয় বিবেচনায় রাখতে হবে । 

v) সাথী ফসল কোন সময় প্রধান ফসলের সাথে প্রতিযোগিতায় গেলে সাথে সাথে সাথী ফসল কেটে দিতে হবে।

মিশ্র বহুস্তরবিশিষ্ট বাগানের জন্য উদ্ভিদ/ফসল নির্বাচন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। এ ক্ষেত্রের নিম্নোক্ত বিষয়গুলোর প্রতি লক্ষ রাখতে হবে ।

বাগানে গাছ লাগানোর জন্য ছায়া পছন্দকারী বা ছায়াসহকারী উদ্ভিদ ফসল হিসাবে চিহ্নিত করতে হবে ।  

নির্বাচিত বিভিন্ন ফসল/উদ্ভিদের সমন্বয় এমন হতে হবে যেন ফসল উৎপাদন চক্র এবং মাত্রা সারা বছর নিয়মিত উৎপাদন নিশ্চিত করতে পারে । আবহাওয়া ও জলবায়ুগত কারণে বছরের কোন কোন সময় ফসল সংগ্রহের পরিমাণ কম বা বেশি হতে পারে; কিন্তু প্রাত্যহিক কিছু না কিছু উৎপাদন যেন অব্যাহত থাকে । অর্থাৎ বছরের প্রায় সবসময়ই যেন ফলন এবং উপজাত হিসেবে জ্বালানি ও অন্যান্য উপকরণ পাওয়া যায় । 

বাগানে উৎপাদিত সামগ্রী কৃষকের দৈনন্দিন চাহিদা মেটাতে সক্ষম হবে এবং অতিরিক্ত আয়, দৈবাৎ কৃষি ফসল হানিতে ও দুফসলের মধ্যবর্তী সময়ে কৃষককে নিরাপত্তা দিতে সক্ষম হবে। পারিবারিক সদস্যদের ন্যূনতম শ্রমের মাধ্যমেই বাগানে গাছের পরিচর্যা ও ফসল সংগ্রহ করা যায় তা নিশ্চিত হতে হবে ।

Content added By

প্রশ্নমালা

0

অতি সংক্ষিপ্ত প্রশ্ন

১। স্বল্পমেয়াদি ফল গাছ কত দিন ফল দিয়ে থাকে ? 

২ । ষড়ভূজ পদ্ধতিতে বর্গাকার পদ্ধতি অপেক্ষা কত শতাংশ গাছ বেশি লাগানো যায় ? 

৩ । মিশ্র বাগানের সুবিধা কী ? 

৪। সাথী ফসল কী ? 

৫ । কন্টুর বা ঢাল এবং সিড়ি বাঁধ পদ্ধতিতে কিভাবে চারা রোপণ করা হয় ?

সংক্ষিপ্ত প্রশ্ন

১। বাগানের নকশা কত ধরনের ? 

২। কুইনকাংশ পদ্ধতিতে প্রতিটি বর্গের মাঝে লাগানো গাছকে কী বলে? 

৩ । ষড়ভুজী পদ্ধতিতে বর্গাকার পদ্ধতির চেয়ে কত ভাগ বেশি গাছ লাগানো যায় ? 

৪ । ফল বাগানের পরিকল্পনার জন্য কি কি বিষয় বিবেচনা করা দরকার, তা লিপিবদ্ধ কর । 

৫ । বর্গাকার পদ্ধতির সুবিধা অসুবিধা লেখ । 

৬। মিশ্র ফল বাগান বলতে কি বোঝায়? 

৭ । ফল বাগানের জন্য কেন পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয় সে সম্পর্কে লেখ ।

রচনামূলক প্রশ্ন 

১। ফল বাগান পরিকল্পনার নীতিমালা সম্পর্কে বর্ণনা কর । 

২ । ফল গাছ লাগানোর নকশাগুলোর নাম লেখ ।  চারা রোপণের জন্য নকশা প্রণয়নে করণীয় পদক্ষেপ সম্পর্কে আলোচনা কর । 

৩ । ফল বাগানে গাছ রোপণ প্রণালির গুরুত্ব কী ? ফল বাগানে বিভিন্ন গাছ রোপণ প্রণালি বর্ণনা কর । 

৪ । বাংলাদেশের প্রেক্ষিতে মিশ্র ফল বাগান তৈরির পরিকল্পনার গুরুত্ব ব্যাখ্যা কর ।

Content added By
Promotion